Jiboner Golpo - Janalar Alo

 জানলার আলো

জানালার আলো - জীবনের গল্প


শহরের প্রতিটা জানালার আলো নিভে গেছে। আমার জানালায় এখনো আলো জ্বলছে। চোখের জানালা খুলে ঘুমেরা পালায় গন্তব্যহীন। মধ্যাকর্ষন শক্তিকে ভেদ করে আমার শব্দহীন আর্তনাদগুলো ছড়িয়ে পড়ে মহাকাশে। যে আর্তনাদের ভাষা আমার স্বজাতি Homo Sapiens গুলো বুঝতে পারেনা। কিন্তু দূরের সেই অস্পর্শী আকাশ ঠিকই বুঝতে পারে আর তাইতো আমার শোকের সাথে সমব্যাদনা জানিয়ে সে পাঠায় বৃষ্টির শোকবার্তা।

বৃষ্টি!
আহ! এই বৃষ্টিতে মিশে আছে গতদিনের কত কথা।
একদিন দুপুর রোদের মধ্যে আমি আর মিতু লেকের পাড় ধরে হাঁটছিলাম। হঠাৎ নামলো ঝুম বৃষ্টি। আমি মিতুকে নিয়ে দ্রুত একটি গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। 
"চলনা বৃষ্টিতে ভিজি", বলেই মিতু দিলো দৌড়। আমিও লেকের পাড়ের পথ দিয়ে মিতুর পেছন পেছন দৌড়াতে দৌড়াতে বললাম, "ভিজে বাসায় গেলে কিন্তু তোমার Problem হবে।"
"Who cares" বলে মিতু দাড়িয়ে হাসতে লাগলো। আমিও হাঁপাতে হাঁপাতে মিতুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মিতু হেসেই যাচ্ছে, আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। মিতুর নাকের উপর একটা বৃষ্টির ফোঁটাকে মনে হলো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবথেকে সুন্দর উজ্জল নক্ষত্র।
তার মুখের উপর বৃষ্টির ফোটাগুলো জোনাক ফুলের মত জ্বল জ্বল করছে। মিতু হাসছে। আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছি! এই বৃষ্টি আর কোনদিন না থামুক, এই নক্ষত্র আজীবন জ্বলুক। এই হাসি মুক্তা ছড়াক অনন্তকাল।

আমার অনার্সের শেষ পরীক্ষাটা দিয়ে এসে মনটা খুব ফুরফুরা ছিলো। মিতুকে ফোন দিলাম। ওপাশ থেকে হ্যালো বলতেই আমি গাইতে শুরু করি " হৈ হৈ হৈ রঙ্গিলা, রঙ্গিলা রে...।"
টুপ করে কলটা কেটে গেলো । পরে জানতে পারলাম কলটা রিসিভ করেছিলো ওর বড় খালামনি। মিতুর কাছে আমাদের সম্পর্কের কথা শোনে খালামনি বললেন, " এ কোন অসভ্য ছেলের সাথে প্রেম করে বেড়াস তুই!" তবে তিনি আমদের ব্যাপারটা আর কারো কাছে বলেননি।

কতদিন মিতুর সাথে কথা হয়না। সুদূর বার্লিন শহরে তার বাসার নাম্বার অথবা তার মুঠোফোন নাম্বারটা আমার জানা নেই। অবশ্য তার স্বামীকে ফোন দিলেও কথা বলা যেতো, কিন্তু তার স্বামীর নাম্বারটাও আমার কাছে নেই।

আবার যদি মিতুর সাথে কথা বলার সুযোগ পাই, তাহলে কোন কথাটা দিয়ে শুরু করবো এবং শেষ করবো কোন কথাটা বলে? অথবা আর কি বা বলার আছে?
শেষ কথা বলেইতো ও সবকিছু শেষ করে গেছে।

রাত বাড়ছে সাথে বাড়তে বৃষ্টির কান্না। আমি জানালায় চোখ রেখে বসে আছি। বৃষ্টির কারনে বাইরে দৃশ্যটা কবরের মত ভারী অন্ধকার। আচ্ছা, কবরে কেমন অন্ধকার! কবরে শুয়েও কি মানুষ পৃথিবীতে রেখে যাওয়া অসংখ্য কথা মনে রাখে? এই কথাটা মনে রাখা আমার খুব জরুরী। মিতু বলেছিলো পরপারেও আমরা একসাথে থাকবো। এপারে আমাদের একসাথে থাকা হয়নি, যদি পরপারে...!

আজ এতো বেশি মিতু, মৃত্যু, কবর, পরপারের কথা মনে পড়ছে কেনো?
আমার জানালার আলো ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসছে। ঘুমেরা ফিরে এসে মস্তিষ্ককে আঘাত করে ছড়িয়ে পড়ছে ধমনী, শিরা, উপশিরায়।
ঘুমের স্পর্শে আমার সারা শরীর অসাড় হয়ে যাচ্ছে। খুব বেশি ঘুম পাচ্ছে। এমন ঘুম আর কোনদিন পায়নি।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ