দূরত্ব - ভালোবাসার গল্প

 

দূরত্ব - ভালোবাসার গল্প


রিমি ক্লাসে আসে সবার প্রথমে..সবচেয়ে সামনের চেয়ারটায় বসে..কারও সাথে কোনো কথা বলে না.. তার পাশের টেবিল সবসময় খালি থাকে..কেউই তার পাশে বসতে চায় না..কোনো ক্লাসে টিচার যদি ধমকে কাউকে সামনে নিয়ে বসায়,তখন শুধু ব্যতিক্রম হয়... তাও ওই ক্লাস শেষ হওয়ার সাথে সাথেই যাকে জোর করে বসানো হয়েছিল,সে ছুটে পেছনের সিটে ফিরে আসে..

টিফিন টাইমে আমরা সবাই পাগলের মত খেলায় মত্ত থাকতাম..! আর রিমি দশ মিনিটের মধ্যে টিফিন খেয়ে পরের ক্লাসের বই বের করে পড়তে থাকতো..
কোনও পরীক্ষায় কোনও বিষয়ে কেউ কোনদিন রিমির চেয়ে বেশি নম্বর পায়নি..
কেউ কেউ বলতো হেড স্যার এর মেয়ে বলে আগে ভাগেই নিশ্চয়ই ওকে প্রশ্ন উত্তর সব দিয়ে দেওয়া হয়..
কিন্তু সেই ধারনা ও ভুল প্রমাণিত হল..
 যখন 'ও লেভেল 'এ সারা বিশ্বে টপ ১৫ জন হাই স্কোরারের মধ্যে একজন হলো সে..
তারপর স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে চলে গেল..
কারো কাছে তার ফোন নম্বর তো দূরের কথা..তার সোস্যাল মিডিয়ায় ও কোন একাউন্ট নেই.. 
সে সকলের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেল..
প্রায় ছয় বছর পর হেড স্যার এর মৃত্যু সংবাদ পেলাম..
আমরা কয়েকজন বন্ধু যারা দেশে কাছাকাছি ছিলাম..সবাই গেলাম..জানাজা ..দাফনের পর আমি আবার উপরে গিয়ে ভাবলাম সৌজন্যমূলক একটু বিদায় নিয়ে আসি..
হঠাৎ মনে হলো লিভিং রুমের এক কোনার একটা সোফায় রিমি বসে আছে..
সাহস করে কাছে গিয়ে কথা বললাম..

:রিমি?আমি শাহেদ..আমাকে চিনতে পারছেন?

রিমি রোবটের মতো উঠে দাঁড়াল.. এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে হাত বাড়িয়ে বললো

:হাই,কেমন আছো রনি?

আমি থতমত খেয়ে গেলাম..রিমি আমার ছোট নাম জানে,এটা আমি কোনদিন সপ্নে ও ভাবিনি..আবার তুমি করে বলছে!! আমি হাত মেলালাম..

: আমি ভালো..মানে..আসলে স্যার এর জন্য সরি..

রিমি মাথা ঝাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো ..তারপর খুব সহজ ভাবেই আমার সাথে অনেক কথা বললো..আমি কোথায় পড়ছি..কি বিষয়ে..ও নিজে কোন বিষয়ে পড়ছে..ভবিষ্যৎ এ কি করতে চায়..খুব সুন্দর করে কথা বললো..

আমার বাসা দু ঘন্টার পথ..আমি একবার ঘড়ির দিকে তাকালাম..নয়টা বেজে গেছে..বের হয়ে যাওয়া দরকার.. 

রিমি সেটাও খেয়াল করলো..

: তোমার বাসায় যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে তাই না?

আমি একটু হেসে বললাম যে..হ্যাঁ..সে আবার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো

:বাই..

:খোদা হাফেজ..ভালো থেকো..

বলে আমি চলে আসছিলাম..

পেছন থেকে রিমি আবার ডাকল..

আমি আবার ঘুরে আসলাম..

:তোমাদের কি কিছু লাগবে?

রিমি কিছুক্ষণ চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো..আমি কি করবো বুঝলাম না..তারপর আবার কথা বলা শুরু করলো..

: আমার আসলে 'এ্যসপারজার সিনড্রম' আছে..এটা এক ধরনের  'অটিজম'.. এই কারনে বাবা আমাকে কখনও কারো সাথে কথা বলতে দিতেন না..আমি মাঝে মাঝে বুঝতে পারি না কখন কি বলা উচিত.. তুমি কি আবার পরে আমার সাথে কথা বলতে চাও?তাহলে আমি তোমাকে আমার সেল ফোন নম্বর দিতাম..

 আমি সাথে সাথে পকেট থেকে ফোন বের করে নম্বর সেইভ করলাম..রিমিকে একটা মিসড কল দিলাম..খুব অবাক হয়ে খেয়াল করলাম রিমির চোখের কোনে পানি জমে উঠেছে..ও অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলো..

আমি বললাম তোমাদের যে কোন কিছু দরকার পরলে আমাকে সাথে সাথে কল দিও আর আমি কাল আবার আসবো..ওকে?

রিমি মাথা ঝাকিয়ে বললো থ্যংক ইউ..

আমি এসে গাড়িতে উঠে দূর থেকে তাকিয়ে দেখলাম রিমি এখনও গেইটে দাড়িয়ে আছে..আমার চোখ ভিজে গেলো..মনে হলো বুক থেকে একটা ভারী পাথর নেমে গেল..


গল্পঃ দূরত্ব
লেখাঃ অলিভা সালমিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ