জলরঙে লেখা বিমূর্ত পাণ্ডুলিপি - এম মনজুরুল ইসলাম

জলরঙে লেখা বিমূর্ত পাণ্ডুলিপি - এম মনজুরুল ইসলাম
এম মনজুরুল ইসলাম


কী খাবে? পেস্ট্রি কেক, নাকি কফি? ফ্রেঞ্চ ফ্রাইও নিতে পারো।
-প্রৈতি বলল, আমি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাই না। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেলে ওজন বেড়ে যায়। ডায়েট চার্ট মেনে চলি। ব্রেকফাস্টে লেমন সেন্টিমেন্ট ও লাইট হিটআপ ওয়াটার থাকে ফুড মেনুতে। তবে কফি নেব।
-ফারনান ওয়েটারকে কল করল। দুকাপ কফি অ্যারেঞ্জ করতে বলল। রেস্টুরেন্টের বেসমেন্টে বসে সে প্রৈতিকে দেখতে থাকে। সেটা অ্যাট অ্যা স্ট্রেচ! কী ফরোয়ার্ড একটা মেয়ে! ফিটনেসের ব্যাপারে বেশ সিনসিয়ার। জাস্ট শি ইজ লুক্স লাইক এ পাবলিক ক্রাশ। অ্যাজ অ্যা কলিগ অব ফারনান- শি ইজ ভেরি কেয়ারিং অ্যাট হিম। বাট হোয়াই? সব সময় লেগিংস সালোয়ার ও অ্যারোপ্লেন কাট কামিজই বেশি পরে প্রৈতি। লিনেন কটনের ওড়না ঝুলিয়ে রাখে বুকের ওপর। মাঝে মাঝে অ্যাম্ব্রয়ডারি করা থ্রি-পিসের জন্য ওকে বেইলি রোডের শপিংমলগুলোতেও নিয়ে যেতে হয় ফারনানকে।
-প্রৈতি বলল, কী ব্যাপার ফারনান, আর ইউ ওকে?
-সে মাথা নাড়ে। খুব দ্রুত টেবিল থেকে টিস্যু পেপারের বক্সটা টেনে নেয়। টেবিল থেকে টিস্যুর বক্স টেনে নেওয়াটা কি কোনো এক্সকিউজ ছিল ওর? হতে পারে! কিন্তু কীসের সেই এক্সকিউজ? ফারনান যে প্রৈতিকে দেখছে- সেটা ওকে বুঝতে না দেওয়ার এক্সকিউজ বুঝি? তখন অবশ্য ঘামে-টামেওনি ফারনান। রেপুটেট রেস্টুরেন্টগুলোতে এসি সব সময় অন করাই থাকে। তাহলে টিস্যু দিয়ে কী করবে ও? সে আর কিছু ভাবতে পারে না। প্রৈতি ফারনানের দিকে তাকায়। কী গাঢ় সেই দৃষ্টি! ফারনান চোখ দুটো নামিয়ে নিল ওর ওপর থেকে। কী বলবে- বুঝতে পারছে না। সারা শরীর ভেঙে ভেঙে আসছে ওর। প্রৈতিকে নিয়ে বাইরে কোথাও বের হলেই কেন জানি সে আনইজি ফিল করে। ওর মনের গ্রন্থিগুলো দিন দিন প্রৈতিকে একটু বেশিই ফিল করতে শুরু করেছে। কীসের এত ফিল প্রৈতির প্রতি? আজকাল কি রাতে ঘুম-টুম কম হয় ফারনানের? সিডাক্সিন খেয়েও কি চোখে ঘুম আসে না? ওয়েটার টেবিলে দুকাপ কফি রেখে গেল।
-ফারনান বলল, কফি নাও প্রৈতি। সেও একটা কাপ হাতে নিল। ঠোঁট ছোঁয়াল কাপে। বেসমেন্ট থেকে বাস টার্মিনাল দেখা যায়। ওদিকে দেখছে ফারনান। গাড়িগুলো একে একে টার্মিনালে ঢুকছে। দু-একটা বেরিয়ে যাচ্ছে দূরে কোথাও।
-প্রৈতি বলল, কী দেখছ অমন করে?
-কই, কিছু না তো!
-তাহলে টার্মিনালের দিকে ওভাবে তাকিয়ে আছ কেন?
-এমনি! আর কিছু নেবে প্রৈতি?
-নো নিড। অ্যাট ফার্স্ট আই হ্যাড টোল্ড দ্যাট- আই ওবে টু ডায়েট চার্ট। লেটস্ গো নাউ।
কাউন্টারে বিল পে করে ওরা পড়ন্ত বিকেলের বিদায়লগ্নে রেস্টুরেন্টের বেসমেন্ট থেকে বের হয়ে রোড্স অ্যান্ড হাইওয়ের ওখানে আসে। ফারনানের বন্দি বন্দি লাগছিল এতক্ষণ রেস্টুরেন্টে। হুট করে একটা রিকশা পেয়ে গেল ওরা। রিকশায় উঠে ফুসফুসভরে শ্বাস নিল ফারনান। পিচঢালা কালো রাজপথে কত গাড়ি!  ছুটে চলেছে ওদের রিকশাটা। চারপাশে বিস্তীর্ণ আবাসিক এলাকা। নতুন নতুন সব অ্যাপার্টমেন্টের কাজ চলছে। প্রৈতি ফারনানের কাঁধে মাথা রাখল।
-সে বলল, তোমার ঘুম পাচ্ছে প্রৈতি?
-না তো! বুঝলে ফারনান, একটা ফিলিংস হচ্ছে।
কীসের ফিলিংস বল তো?
-সে তুমি বুঝবে না!
ফারনান আর কিছু বলে না প্রৈতিকে। রাজউকের এরিয়া পার হয়ে ওদের রিকশাটা যে কখন ব্রিজের ওপর এসেছে- টেরই পায়নি। কংক্রিটের ব্রিজ ওটা। সুগভীর খাত নিচে। খাত হলেও শুকনো। ব্রিজের নিচে পানি নেই। অনেকটা বিরান ভূমির মতো। ব্রিজের ওপারেই একটা পুরোনো গোছের বাংলো। রিপেয়ার করা হয়নি বোধ হয় বহুদিন! এখন কেউ থাকেও না ওখানে। একসময় রেল কর্মকর্তারা থাকত সেখানে। বাংলো লাগোয়া বিশাল বিশাল টাওয়ার। কোনোটা ইলেকট্রিসিটির টাওয়ার, আবার কোনোটা মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার ছিল ওগুলো। টাটকা বাতাস ঝেঁপে বসতে লাগল ফারনানদের গায়ে। প্রৈতি একটু আনমনা হয়ে ওঠে।
-ফারনান বলে, কী হয়েছে?
-প্রৈতি বলল, বাতাসটা বেশ ফ্রেশ। সে লাস্যময়ী ভঙ্গিতে আবার তাকাল ফারনানের দিকে। ওর এই তাকানোর অর্থটা ফারনান খুব একটা ভালোভাবে বোঝে না। রিকশা তখন পুরোনো ওয়াটার পাম্পের কাছাকাছি। রেল-স্টেশন থেকে কয়েক কিলো পেছনে ওয়াটার পাম্পটা। তারপর রেল-পুলিশের চেকপোস্ট। ফুস্সুত করে একটা শব্দ হলো। আচমকা রিকশাটা থেমে গেল। চাকার দিকে তাকাল ফারনান। প্রৈতি খুব শক্ত করে ফারনানকে জড়িয়ে ধরে। আঁতকে উঠল ওরা।
-ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে মামা?
-চাকা পাংচার স্যার। সাড়তে দেরি হবে। তাছাড়া আশেপাশে কোনো মেকানিকও নেই। কী আর করা- রিকশা থেকে নেমে পড়ল ওরা।
-প্রৈতি বলল- চল, পুরোনো বাংলোটার ওদিকে যাই। ওর এই কথায় ফারনানের কেন জানি হার্টবিট বাড়ছিল। কারণ পরিত্যক্ত এসব জায়গায় প্যারানর্মাল অ্যাকটিভিটি আঁচ করা যায়। যাবে কি না, ভাবছে। উইয়ার্ড কিছু ঘটলে তখন কী হবে? প্রৈতি হাঁটতে শুরু করল। সাথে ফারনানও। চার-পাঁচ বিঘা জায়গার ওপর বাংলো বাড়িটা। ইউজ্ড কলাপসিবল গেট পার হয়ে বাংলোর কম্পাউন্ডে ঢুকতেই একপাল রাতচরা পাখির দাপাদাপি বেড়ে গেল। কন্ঠে রোনাজারি। আর্তনাদও হয়তো বা! ফারনানদের আসাটা কি তাহলে ওদের ভালো লাগেনি? ডিস্টোপিয়ান মেঘগুলো বাতাসে মিশে গিয়ে ফারনানের শ^াসনালি খুঁজতে লাগল। পুরোনো সিঁড়ি বেয়ে যতই ওপরের দিকে উঠছে, ততই ফারনানের ভেতরে অক্সিজেনের শূন্যতা অনুভূত হতে থাকে। প্রৈতি নির্ভার। ওর কোনো দিকেই হেলদোল নেই। ভাবটা এমন- যা হবার হবে! ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই কেন জানি গায়ের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেল ফারনানের। সোফাসেটগুলো এলোমেলো, সবগুলো টিউব লাইট ভেঙে পড়ে আছে মেঝেতে, ডিশের তারে মরা ইঁদুরের শুকনো চামড়া লেপটে আছে, দেয়ালে সাঁটানো এলইডি টিভির গ্লাস ফাটা, ফ্যানের সুইচ বক্সে স্কাইলার্ক পাখির বাসা। কী একটা অস্থির অবস্থা! পুরো শরীর ছমছম করতে লাগল। জানালাগুলো সেঁটে দেওয়া হলেও ¯ স্লাইড গ্লাসগুলো ভাঙা। ফারনান জানালার পাশে এসে দাঁড়াল। এটা ওর পুরোনো অভ্যাস। কোথাও বড় ধরনের জানালা দেখলেই গা ঘেঁষে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। প্রৈতি বাথরুমে। বাথরুমের দেয়ালে অসংখ্য টিকটিকি, ইউরিনালের পাশে বড় বড় মাকড়সা। বড্ড রূঢ় এক পরিস্থিতির সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে ওরা। এখানে আসার কি কোনো দরকার ছিল? জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল ফারনান। সন্ধ্যা তার নিজস্ব নিয়মমাফিক ঝাঁপি খুলতে শুরু করেছে। খুলুক! বাংলো এরিয়ার মাঝখানে খেলার স্পেস, ছোট ছোট লেক, পাঁচিলের ওপর তারকাঁটা লাগানো। ডেকোরেশনটা ভালোই লেগেছে। কিন্তু এখানে এখন কেউ থাকে না কেন? অদ্ভুত রকমের নীরবতা চারদিকে। সবই যেন স্থির! জানালা দিয়ে ওয়াসার অফিস দেখা যায়। এখন আবছা দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সময় পরিবেশটা একটু আবছা হবে- এটাই স্বাভাবিক।
প্রৈতি এল। বলল, এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন ফারনান? সে কী বলবে ওকে?
-বলল, পরিবেশটা বেশ ভার ভার, তাই না প্রৈতি?
-হ্যাঁ, তা ঠিক বলেছ। শুধু ভার ভার না, ভীষণ রকমের ভৌতিকও বটে।
-ফারনান জিজ্ঞাসা করল- কেন, উইয়ার্ড কিছু দেখেছ নাকি?
-না, তা দেখিনি। এই মুহূর্তে সময়টা বড্ড মুখিয়ে আছে। কখন কী ঘটে- বলা মুশকিল। ছাদের প্লাস্টার উঠে গিয়ে জঙধরা রডগুলো হিসহিস করছে। যেকোনো মুহূর্তে ধসেও পড়তে পারে মাথার ওপর। জানালার কাছ থেকে সরে গার্ডরুমের দিকে গিয়ে দাঁড়াল ওরা। নিপাট নিঃশব্দতা এখানেও। পাশাপাশি দুজন দাঁড়িয়ে থাকলেও ফারনান প্রৈতিকে অনুভব করতে পারছিল না। গোগ্রাসে কী যেন একটা খামচি দিতে চাইছে ওদের! বুকের চাতালে গুমরে গুমরে উঠছে অজানা এক যন্ত্রণা। উথলে উঠছে চারদিকের নিঃসঙ্গ পরিবেশ। ধীরে ধীরে পা দুটো স্থবির হয়ে আসছে ফারনানের। সেটা কি ভয়ে? নাকি দাপিয়েপড়া সময়ের অস্থিরতার জন্য? প্রৈতির হাত ধরে ছাদে উঠতে লাগল ফারনান।
রাশভারি কন্ঠস্বরে প্রৈতি জিজ্ঞাসা করল- আমরা এখানে না এলেও পারতাম, তাই না ফারনান?
-জি। খুব মৃদুস্বরে শুধু ওটুকুই বলল ফারনান। ছাদের কাছাকাছি চিলেকোঠার ওখানে আসতেই বিকট একটা আওয়াজ কানে এল ওদের। কী হলো ব্যাপারটা? চমকে উঠল ওরা আরেকবার। চিলেকোঠার দিকে এগিয়ে গেল। দেখল, সাইজে বড় একটা বিড়াল চিলেকোঠা থেকে পানির ট্যাঙ্কির ওপর ঝাঁপ দিয়েছে। তাতেই এত শব্দ? ধ্যাত্তারি! বুকে একরাশ থুতু ছিঁটাল ওরা। ছাদের একপাশে একটা ডিশ অ্যান্টেনা। তারটার ছিঁড়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন সংযোগ। কৃষ্ণচূড়ার ডাল পুরো ছাদের অর্ধেকটা অংশজুড়ে। কেউ যে এই বাংলোয় বহুদিন হলে আসে না- সেটা বুঝতে বাকি থাকল না ওদের। ছাদের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পায়চারি করতে করতে পানির পাইপগুলোর সাথে পায়ের আঙুল জোরসে আঘাত লাগে ফারনানের। মুখ থুবড়ে পড়ে যায় ছাল ওঠা ছাদের ওপর। নাক ফেটে গলগল রক্ত আসতে শুরু করে। প্রৈতি জাপটে ধরে তুলে নেয় ফারনানকে। ওর লিনেন ওড়না দিয়ে বারবার রক্তগুলো মুছে দিতে থাকে সে। টিস্যু পেপার থাকলে না হয় সেগুলো দিয়েই রক্তগুলো মোছা যেত। রেস্টুরেন্ট থেকে আসার সময় দু-একটা নিয়ে এলেও তো পারত ওরা! ধুর ছাই, এখন এসব ভেবে কী লাভ? কী তাজা রক্ত! রক্ত দেখলে একসময় ফেইন্ট হয়ে যেত ফারনান। এখন অতটা অস্বস্তি লাগে না ওর। সন্ধ্যার বুকচিরে একধরনের দমকা প্রতিক্রিয়ার ভলিয়্যুম শুনতে থাকল ওরা। ঝরা পাতার খসখস শব্দে সন্ধ্যা যেন এগিয়ে যাচ্ছে রাত্রির শামিয়ানায়। রক্ত তখনো ঝরছে। অবাক হলো প্রৈতি। চোখে মুখে ওর ভাবনার বুদবুদ। কী করবে, ভেবে পাচ্ছে না বোধ হয়! সে পানির ট্যাঙ্কিতে পানি খুঁজতে গেল। মাথায় পানি দিলে রক্তপড়া হয়তো বা বন্ধ হতে পারে। কিন্তু ট্যাঙ্কির ভেতর টেরিস গজিয়েছে। শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে ট্যাঙ্কির চারপাশের দেয়াল। নিচের দিকে কিছুটা পানি থাকলেও- সেগুলো কালেক্ট করা ইম্পসিবল। পানিগুলো তো ইউজলেসও হতে পারে, কিংবা পয়জোনাস! ফারনানের নাকটা চেপে ধরে প্রৈতি। শ^াস নিতে পারছিল না সে। তারপরেও যদি রক্ত ঝরা বন্ধ হয়- ক্ষতি কী? নাকটা ব্যথায় টনটন করছে। ঠকঠক শব্দ হচ্ছে মগজের ভেতর। গাঢ় সন্ধ্যার ছায়া এসে গিলে ধরছে ওদের একটু একটু করে।

দুই.

অ্যাপার্টমেন্ট অব গ্রিনরোড। অ্যারিসটোক্র্যাটিক এরিয়া। অ্যাপার্টমেন্টের রেসট্রিক্টটেড কম্পাউন্ড থেকে একটু দূরেই ফ্লেক্সিলোড সার্ভিস পয়েন্ট। পাঁচতলা অ্যাপার্টমেন্ট এটা। বাসের টিকিট কাউন্টারগুলো তার সামনেই। রাস্তার ওপারে ওয়েটিংরুম। অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় হৃদিকা গাড়ি থেকে নেমে ফ্লেক্সিলোড করে নিল। পাঁচতলায় থাকে ওরা। বাকি ফ্ল্যাটগুলো রেন্টে আছে। হৃদিকার বাবা সাব-রেজিস্ট্রার ছিলেন। রিটায়ার্ড করেছেন এখন। অ্যাপার্টমেন্টটা ওদেরই। লিফটে করে পাঁচতলা পর্যন্ত উঠে এল সে। ওর বেডরুম লাগোয়া একটা ইজি চেয়ার। ফ্রেশ না হয়েই ওখানে সে বসে পড়ে। ইজি চেয়ারে বসতেই হাতের ব্যান্ডেজের ওপর কী যেন একটা কষে আঘাত করে। সেন্সলেস হওয়ার মতো কন্ডিশন ফিল করল হৃদিকা। গতকাল অফিস কম্পাউন্ডে গাড়ির গেট ওপেন করতেই ভাঙা কাচ দিয়ে কীভাবে যে হাতের সফ্ট স্কিনে চির ধরেছিল- বুঝতেই পারেনি সে। আর কাচই বা কোত্থ থেকে এল- সেটাও ওর কাছে মিরাকেল। অ্যাট অ্যা টাইম দ্যাট ওয়াজ কনফিউজিং ইনসিডেন্ট। দেয়ার ওয়াজ নো স্কোপ টু আন্ডারস্ট্যান্ড অ্যাবাউট সারোন্ডিংস ব্যাকগ্রাউন্ড। তাছাড়া আজ যা ধকল গেছে অফিসে! লাঞ্চ আওয়ারের পর মিটিং শুরু হয়ে চারটে নাগাদ শেষ হয়েছে। শরীরের কোষে কোষে ক্লান্তি গেঁড়ে বসেছে হৃদিকার! মানসিকভাবেও চরম বিধ্বস্ত। আজ কেন জানি ফারনানকে খুব ফিল করছে হৃদিকা! সেপারেটের এত বছর পর ওর প্রতি এমন ফিলিংস খুব একটা এর আগে কখনো হয়নি হৃদিকার। ওদের কেন এই সেপারেশন? প্রৈতির জন্য? ফারনানকে একবার ফোন করবে নাকি হৃদিকা? থাক, এখন না। পরে কখনো! মিউচ্যুয়াল সেপারেশনের পর হৃদিকার খুব একটা কমিউনিকেশন হতো না ফারনানের সাথে। তবে ডিভোর্স হয়নি ওদের। ওয়েল সেটেল্ড, এডুকেটেড এবং রিচ ফ্যামিলিতে বিলং করা হৃদিকা দিন দিন মেন্টালি সিক হয়ে পড়ছে। হাইপারটেনশন, ইন্সমনিয়া, হাইপ্রেসারও দেখা দেয় মাঝে মাঝে। রুদ্র এল ওর কাছে।
-বলল, মাম্মি, কখন এলে অফিস থেকে। রুদ্রকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিল হৃদিকা।
-একটু আগেই ফিরেছি বাবা! দুপুরে লাঞ্চ করেছ?
-জি, করেছি। কী হয়েছে মাম্মি তোমার?
রুদ্রর এই প্রশ্নের উত্তর কীভাবে দেবে হৃদিকা? ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সে রুদ্রর মুখের দিকে। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে চিপসের প্যাকেট বের করে রুদ্রর হাতে দেয় সে।
-বলে, তোমার জন্য চিপস নিয়ে এসেছি। তুমি না চিপস পছন্দ কর খুব!
এভাবে আর কত দিন? রুদ্র কি কখনো বড় হবে না? বাবার কথা জানতে চাইলে হৃদিকা কীভাবে বোঝাবে ওকে? সারা শরীর নাড়া দিয়ে ওঠে হৃদিকার। চোখজুড়ে ঢুলুনি ঘুমের রেশ। অথচ সারা রাত ফজরের আগ পর্যন্ত একবারের জন্যেও দুচোখের সীমানায় ঘুমের পদচিহ্নটিরও দেখা পায় না সে। হৃদিকার ভেতরটা জ¦লে পুড়ে খাঁক হয়ে যেতে থাকে। রুদ্র ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। রুদ্রর অপ্রশস্ত দৃষ্টিজুড়ে কী রকম এক অদ্ভুত বিচিত্রতা! সে কি কিছু ঠাওর করতে পারছে তাহলে? হৃদিকা রুদ্রর ঠোঁটে আলত করে চুমু এঁকে বলে- অমন করে কী দেখছ বাবা? আমার কিছু হয়নি তো! তুমি অতটা টেন্সড কেন? অতটুকুন রুদ্র কি সত্যিই অনেক টেন্সড ছিল হৃদিকাকে নিয়ে? ইজি চেয়ার ছেড়ে বিছানায় গিয়ে বসে হৃদিকা। ওর সারা মুখ কেমন শুষ্ক! বাইরে তাকায় সে। জানালা দিয়ে যতটুকুন দেখা যায়, দেখে নেয়। প্রকৃতিটা মুখ গোমরা করে আছে মনে হলো। ওর রুমের পেছনের দিকটায় অশ^ত্থের চারা গজিয়েছে। অনেকগুলো অশ^ত্থের চারা। পাঁচতলা থেকে স্পষ্টভাবে সবগুলো খুব একটা দেখা যায় না। মাথার ওপর এসবেস্টরসের ছাদ। মেঝেতে দামি কার্পেট বিছানো। বেডরুম থেকে একটু দূরে কম্পিউটার ডেস্ক। বেতের তৈরি কয়েকটা সোফাসেট বেডরুমের লেফ্ট সাইডে। দেয়ালে বড় বড় সব বিদেশি পেইন্টিং। এমন করে ডেকোরেশনের প্ল্যান করেছিল ফারনান। টেবিলের ওপর পানির গ্লাস রাখত সে। ডেস্কে বসে অফিসিয়াল পেন্ডিং কাজগুলো করত সারা রাত। গলা শুকিয়ে এলে একঢোক পানি খেয়ে নিত গ্লাস থেকে। হৃদিকা ঘুমাত তখন বিভোর হয়ে। কোথায় গেল ওর সেই ঘুমানোর রাতগুলো? কেন এমন করল ফারনান? সে কি একবারও রুদ্রর কথাটা ভাবেনি? প্রৈতির সাথে কীসের এত ঢলাঢলি ওর? অফিসের কলিগের সাথে ইলিগ্যাল অ্যাফেয়ার কীভাবে মেনে নেবে হৃদিকা? ভীষণ রকমের বিমর্ষ হতে থাকে সে। ফ্যানের সুইচ অন করে। ইলেকট্রিসিটি নেই। রুদ্র ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বাথরুমে যায় হৃদিকা। অফিস থেকে ফিরে টায়ার্ড ফিলের জন্য তখন সে ফ্রেশ হয়নি। চোখ-মুখ পানিতে ধুয়ে নিল। বাথরুমের আয়নার দিকে তাকায় হৃদিকা। একটা ম্যাড়মেড়ে ফেস আয়নায় দেখা যায়। তেলতেলে, কালচে, ব্রণের স্পট মুখজুড়ে। এখন আর সে আগের মতো কসমেটিক্স ইউজ করে না। বডিতে পারফিউমও স্প্রে করতে ইচ্ছে করে না ওর। বাথরুমের ভেন্টিলেটারের ফাঁক গলিয়ে সাদা তুলোট মেঘ ভেসে যেতে দেখে সে। ভেন্টিলেটারের ওদিক থেকে দৃষ্টি নামিয়ে নেয় হৃদিকা। তারপর স্যাভলন দিয়ে হাতের ক্ষতটা ভালোভাবে ক্লিন করে। ব্যান্ডেজের ওপর রক্ত জমে ছিল। কালচে রঙের রক্ত। শুকিয়ে গেছে তো, তাই কালচে! রক্তগুলো শুকিয়ে ক্ষতস্থানটাকে একেবারে সাপটে জড়িয়ে ধরে রেখেছে মনে হয়। কোনোভাবে ব্যান্ডেজটা খুলে ফেলল হৃদিকা। কী দগদগে স্পট হাতে! সেলাই করলেই বোধ হয় বেটার হতো। এমন করে হা হয়ে থাকত না। তবে ব্যথা কিছুটা কমেছে। পেইন কিলার খেয়েছিল বেশ কটা। কিন্তু হৃদিকার হৃদয়ে যতটুকু ব্যথা- সে ব্যথা কমবে কোন ওষুধে? বাথরুম থেকে বেডে আসে সে। ওর মা তখন রুদ্রর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।
-কখন এলে মা?
-চার-পাঁচ মিনিট তো হবেই। এসে দেখি তুই নেই। রুদ্র ঘুমোচ্ছে। তাই ওর পাশে বসলাম। হ্যাঁ রে হৃদিকা- তোর হাতের এখন কী অবস্থা?
-ব্যথা কমেছে, কিন্তু ক্ষতটা এখনো জ¦ালাতন করছে। আরও কিছু দিন জ্বালাবে হয়তো বা! বাবা কোথায় মা?
-রিডিং রুমে।
-উরফি?
-ওর রুমে। ঘুমোচ্ছে।
-এই অবেলায় কীসের ঘুম?
-ভার্সিটি থেকে ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছে। কেন, কিছু বলবি?
-না, এমনিই জিজ্ঞাসা করলাম আর কী!
-চা খাবি তুই?
-না মা, এখন চা খাব না।
-রুদ্রকে আমাদের রুমে নিয়ে যাব হৃদিকা?
-না, ও আমার বেডেই ঘুমাক।
টাওয়াল দিয়ে মুখটা মুছে নিল হৃদিকা। জানালার শার্সিগুলো নড়তে শুরু করল এমনি এমনিই। হ্যাংলা-পাতলা সময়গুলো ফস্কে যাচ্ছে মৃদু পায়ে। হৃদয়ে মটকা মেরে বসে থাকা দুঃসময়ের শকুন বারবার খুবলে রক্তাক্ত করতে চাইছে ভেতরকার শব্দগুলো। এভাবেও হয়তো বা জলরঙে লেখা যায় অপেক্ষার এক একটা বিবর্ণ থিউরি!

তিন.

রক্তক্ষরণ হচ্ছে। থকথকে তাজা রক্ত। হৃদয় থেকে রক্তক্ষরণের এমন আওয়াজ এর আগে আর কখনো শোনেনি শাহুক। কমপ্লিটলি গ্রিজলি সাউন্ড অব ব্লাড। যন্ত্রণায় পোড়া শরীরের যেরকম ছ্যাঁচড়া গন্ধ- তা খুব সহজে নাকে আসে না। ল্যাগেজপত্র গুছিয়ে নিল সে। মেট্রোপলিটনে ফিরে যাবে আজই। পঁয়ত্রিশতম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত এএসপি শাহুক। ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ারে সে কত ইলিগ্যাল কাজকে সামলে নিয়েছে! কিন্তু ইন্টারনাল প্রাইভেসিকে কীভাবে সামলাবে ও? এক মুহূর্তের জন্যেও শাহুক আর প্রৈতির সাথে থাকতে চায় না। এমন এদো-খেদো সম্পর্ক নিয়ে এক ছাদের নিচে থাকার কি কোনো মানে হয়? কোনো হাজব্যান্ড ওয়াইফের অ্যাফেয়ার মেনে নিয়েছে কখনো? ওয়াড্রব থেকে টি-শার্ট বের করে গায়ে দিল শাহুক। জিন্স পরনেই ছিল। প্রৈতি নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে সে। আর বলারই বা আছে কী? শাহুক বেশ ফুঁসছিল প্রৈতির ওপর। সেটা কি অস্বাভাবিক? খটখটে চোখে প্রৈতির দিকে তাকায় সে। ওই চোখজুড়ে ছিল ঘৃণার আগুন। সেই আগুনে যদি ওকে পোড়াতে পারত- তাহলে বোধ হয় শাহুকের রাগের খিদেটা কিছুটা হলেও মিটত। রিনথি এল শাহুকের রাগান্বিত কনভারসেশন শুনে।
-জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে ভাইয়া? ল্যাগেজ গুছিয়ে রেখেছ কেন? কোথাও কি যাচ্ছ তোমরা? রিনথির প্রশ্নের কোনো অ্যানসার শাহুকের কাছে ছিল না। কিছু বুঝতে পারছে না রিনথি। তবে আঁচ করতে পারছে নিশ্চয়ই বেটার কিছু হয়নি। শাহুকের দিকে এগিয়ে গেল রিনথি।
-বলল, কী হয়েছে তোমার? তুমি তো এমন করে কখনো ভাবীর ওপর রেগে থাকো না! প্রৈতি সোফায় বসে আহত পাখির মতো তড়ফাচ্ছে বারবার। সেও কোনো কিছু বলতে পারছে না রিনথিকে। কোন মুখে বলবে ওর অ্যাফেয়ারের কথা? রেপুটেট ফ্যামিলির ওয়াইফ হয়ে অফিসের কলিগের সাথে অ্যাফেয়ার? এটা ভাবতেও কেমন মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে শাহুকের। প্রৈতির পাশে এসে বসল রিনথি। চোখ দুটো জলে টলটল করছে ওর। চোখ জলে ভেজা হলেও তাতে অপরাধের আলামত স্পষ্ট। রিনথি কি প্রৈতির অ্যাফেয়ারের ব্যাপারে কিছুই জানে না? কী করে জানবে? ইলিগ্যাল হলে যা হয় আর কী! তাছাড়া প্রৈতি তো বাসা থেকে বেরিয়ে যায় নটায়, কিংবা তার আগে। ফেরে চারটের পর। বাইরের ইনসিডেন্টগুলো কি রিনথির জানার কথা? রিনথি তাকিয়ে আছে প্রৈতির মুখের দিকে। প্রৈতির বুকের ভেতর খুব তুকতাক করছে। অসাড় হয়ে আসছে চারপাশ। শাহুকের রেসপন্স আর আগের মতো অতটা নেই। রাগে চোখ দুটো লাল হয়ে থাকলেও ওই চোখে এখন বিভাজনের অলিখিত পাণ্ডুলিপি জলছাপ। শাহুকের হঠাৎ করে চুপচাপ হয়ে যাওয়ার মিনিংটা প্রৈতির অজানা নয়। ভয় লাগতে শুরু করে ওর। কী করতে চায় শাহুক? প্রৈতি ওর বিষণ্ণ মুখে কিছু বলার এনার্জি একদম হারিয়ে ফেলেছে। ঝিম ধরে আছে রিনথির পান্ডুর দৃষ্টি। অবিরত যন্ত্রণাগুলো লাট খেতে থাকে শাহুকের বুকের ওপর। ধপাস করে সে খাটের ওপর বসে পড়ে। বুঁদ হয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকে প্রৈতি। মনে হচ্ছে কেউ একজন ইচ্ছে করেই শাহুকের শরীরের ওপর স্কেভেটার দিয়ে খোঁচাচ্ছে। চিৎকার করে উঠবে না কি সে? এএসপির ট্রেনিং-এ মাথা কুল রাখার যে টিচ সে নিয়েছিল- সেই অ্যাওয়ারনেসটায় এখন ওকে অ্যাপ্লাই করতে হবে। চোখ বন্ধ করে ফেলল শাহুক। নিবিড় নিস্তব্ধ করল শরীরের প্রতিটি ভেইনকে। ব্লাডের উত্তাপকেও কমাল। রিনথি চা করতে কিচেনে চলে গেল। প্রৈতি শাহুকের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। কী সিলি, কী শ্লেষে ভরা কন্ঠস্বর শাহুকের! ওকে কীভাবে অ্যাভয়েড করতে পারে প্রৈতি? ওর হৃদপিণ্ডটা শূন্যতায় ভরে উঠল। শাহুকের গা ঘেঁষে বসল প্রৈতি। ওর হাতটা বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিল সে। শাহুক নির্বিকার তখনো। কিছুই বলল না প্রৈতিকে। কিন্তু ঘৃণা  আর লজ্জায় শরীরটা রি রি করে উঠল ওর। লাইফ থেকে প্রৈতিকে চিরতরে ডিসচার্জ করবে নাকি শাহুক? একটা মৃত ছাল ছেলা ক্যাকটাস ট্রি ও টব রুম থেকে সরানোয় বোধ হয় ভালো। শাহুক নিজের মনের মেজরিটিকে অ্যাপ্রিসিয়েট করে সব সময়। ওর মনে প্রৈতি এখন বিমূর্ত এক পাণ্ডুলিপি। শাহুক খাট থেকে উঠে দাঁড়ায়। ল্যাগেজ খুলে কাপড়চোপড়গুলো ওয়াড্রবে রেখে দেয়। যেকোনো ধরনের ক্রাইসিসেই সে নিজেকে ট্র্যাকেল দিতে বেশ সিদ্ধহস্ত। দেয়ালের একপাশে গেল শাহুক। যেখানে কাপড় রাখার কেবিনেট। তার সাথেই পাবলো পিকাসোর আঁকা গোয়ের্নিকা প্রেজেন্টমেন্ট। বিশাল ক্যানভাসে আঁকা প্রেজেন্টমেন্ট ওটা। যেটা ধ্বংসের বিরুদ্ধে এক দৃঢ় প্রতিবাদ। ওখান থেকে জানালা দিয়ে ধানমন্ডি সড়কের প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্ট দেখা যায়। কী যেন অসহায়ের মতো দেখছে সে! নিজের অস্তিত্বকে খোঁজার চেষ্টা করছে হয়তো বা শাহুক।
-প্রৈতি বলল, কী হলো তোমার? ওর দিকে আড়চোখে তাকাল সে। তবে ওই তাকানোয় গভীরতা না থাকলেও, বিচ্ছেদের মেলডি ছিল। দুকাপ চা নিয়ে এল রিনথি।
-বলল, ভাইয়া, এই নাও চা! প্রৈতিকেও দিল এককাপ।
শাহুক চা খেতে খেতে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। নিজেকে সার্টিফাই করার চেষ্টা করতে থাকে ও। কিন্তু কোনো সলিউশনে আসতে পারছে না কেন? কাঁপুনি ধরে কলিজায়। হৃদপিণ্ডের রক্ত প্রবাহ দিক বদল করতে থাকে অবিরত। আকাশের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘগুলো অজানায় উড়ছে। অ্যালজাবরার মতো সহজ করে হিসাব কষতে চেয়েও পারছে না শাহুক। গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে কীসের যেন একটা মিউজিক ভেসে আসছে! ওদিকে কান পাতে সে। ‘কে আবার বাজায় বাঁশি, এ ভাঙা কুঞ্জবনে/হৃদ মোর উঠল কাঁপি, চরণের সেই রণনে/কে আবার....’ অতুলপ্রসাদ সেনের গান। কী সপ্তক টিউন, কী গভীর লিরিকের নিঃসঙ্গ সব শব্দ!

চার.

সটসার্কিট হয়ে ইলেকট্রিক লাইনের সবগুলো তার জ¦লে-পুড়ে খসে পড়েছে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলোরও সুইচড অফ। পুরো শহরজুড়ে এখন চলমান লোডশেডিং-এর বেসাতি। উরফি এমন ঘুটঘুটে অন্ধকারেও গাড়ি ড্রাইভ করছে। ট্রাফিক পুলিশের কোনো চেকপোস্ট চোখে পড়ছে না। স্ট্রিট শপগুলোতেও ভিড়-ভাট্টা নেই। শহরটা স্ট্রেক-প্লেট অন্ধকারে ডুবে থাকলেও, গাড়ির হেডলাইটে সব কিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে উরফি। হৃদিকা পেছনের সিটে বসে আছে নিঃশব্দে। রুদ্র ছিল না ওদের সাথে। বাসায় রেখে এসেছে ওকে। অফিসিয়াল মিটিং থাকলে রুদ্রকে সঙ্গে নেয় না হৃদিকা। গাড়ি তখন কনফেকশনারি শপ এরিয়াতে। গাড়ি স্টপেজ দিতে বলল হৃদিকা।
-উরফি বলল, কেন আপু?
-হালকা খয়েরি রঙের প্যারা সুইটমেট কিনব। রুদ্র সুইটমেট খাবে কদিন হলেই বলছিল।
উরফি গাড়ি ব্রেক করল একটা ডেকোরেটেড কনফেকশনারি শপের সামনে। শহরে লোডশেডিং চললেও শপটাতে জেনারেটর স্টার্ট করা ছিল। দু-প্যাকেট খয়েরি সুইটমেট কিনেই গাড়িতে উঠল হৃদিকা। ঘড়িতে রাত সাড়ে আটটা। খুব কি বেশি? শহরের মধ্যরাত মানেও রাতের প্রথম প্রহর। জানালার কাচ নামিয়ে দিল হৃদিকা। শির শির করে বাতাস ঢুকছে ভেতরে। দিনে তাপমাত্রা বেশি থাকলেও রাতের ঢাকা শহরটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। উরফি নজর নিবন্ধ করে রেখেছে স্টিয়ারিং হুইলের ওপর। হৃদিকার মনটা মাঝে মাঝে বনসাঁই গাছের মতো রূপ নেয়। কী যে হয় ওর? নিজেকে ভালো রাখার ফিকির খুঁজেও পায় না সে। পুরান ঢাকা থেকে গ্রিনরোডের দিকে যাচ্ছে ওদের গাড়িটা। গ্রিনরোডের ৩/এ বাসাটা ওদের। রাস্তা কম নয়। টায়ারের কোঁ কোঁ শব্দ হচ্ছে। ওরকম প্রতিদিনই তো হয়! ড্রাইভ করতে করতে মাঝে মধ্যে গলাটা শুকিয়ে আসে উরফির। মিনারেল ওয়াটারের ছিপি খুলে একঢোক পানি খেয়ে নেয় সে। রাস্তার চারপাশের ঝাঁপানো গাছগুলো অন্ধকারের সাথে মিশে গিয়ে গাড়ির সাথে সাথে রেসিং করছে মনে হলো। যেটা উইয়ার্ড লেগেছে হৃদিকার কাছে। বেওয়ারিশ কুকুরেরা ঘেউ ঘেউ করছে গলির মোড়ে মোড়ে। দিনের বেলা কিন্তু এতগুলো কুকুর দেখা যায় না। রাতে কোত্থ থেকে যে আসে এরা? উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে হৃদিকা। উরফির কোনো দিকে খেয়াল নেই। রেডিয়্যান্ট প্রস্টিটিউটরা ক্লায়েন্টের জন্য যেকোনো ধরনের প্রাইভেট কার একটু ¯স্লো করলেই ছুটে যাচ্ছে সেদিকে। কী একটা ইমব্যারাসমেন্ট! ভালো লাগেনি হৃদিকার।
-সে উরফিকে বলল, গাড়ির স্পিড আরেকটু বাড়িয়ে দে। বাংলাদেশে একচিলতে অ্যাকোমোডেশনের জন্য এখনো মানুষ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে নিজেকে বিক্রির জন্য- এটা ভাবতেই মুষড়ে পড়ে হৃদিকা। গাড়ির জানালার কাচ উঠিয়ে দেয় সে। সিটের সাথে হেলান দিল হৃদিকা। চোখ বন্ধ করে। বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে যদি একটু তন্দ্রা আসে, আসুক না। তন্দ্রা আসতে চাইলেও গাড়ির ভেতরকার মৃদু শব্দে সে তন্দ্রা কোনোভাবেই মগজে গেঁড়ে বসতে পারছে না। আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় হৃদিকা। বিরাট বিরাট বিলবোর্ডগুলো রাস্তার পাশকে চেয়ে থাকার মতো করে তুলেছে। তাতে ডিজিটাল প্রিন্টিং-এর সাহায্যে ফটোগ্রাফির ছবি সাঁটানো। কী ইন্টারেসটিং! মন ডুবিয়ে ওসব দেখছে হৃদিকা। এমন অন্ধকারেও ফটোগ্রাফিগুলো দৃষ্টিকে নন্দিত করে তুলছে ওর।
-উরফি বলল, আপু ঘুমিয়ে পড়লে?
-আরে নাহ, তন্দ্রা এলেও ঘুম আসেনি চোখে। লং টাইম ড্রাইভ করছিস। ড্রাইভ করতে বোর ফিল করছিস?
-না তো!
-না পারলে আমাকে দে।
-টেনশন কর না আপু। তুমি রেস্ট নাও।
হৃদিকার হাতের ক্ষত তখনো পুরোপুরি শুকিয়ে যায়নি। লং টাইম ড্রাইভ করলে ওখানে পেইন হয়। ফুলে ওঠে। তা না হলে সে নিজেই ড্রাইভ করত। উরফিকে সঙ্গে নিত না। প্রতিদ্বন্দিহীনভাবে সময় চলে যাচ্ছে। গাড়ির চাকার কোনো নিস্তার নেই। অবিরাম ঘুরছে। গ্রিনরোডে পৌঁছাতে এত সময় কেন লাগছে? গ্রিনরোড কি গ্রিনরোডের জায়গায় নেই? চোখ দুটো একটু বড় করল হৃদিকা। সামনে দেখল গ্রিনরোডের সাইনবোর্ড। বামে গ্রিনরোড। একটা ইউটার্নও সেখানে। ওই ইউটার্ন থেকে ৩/এ বাসাটা দু-তিন মিনিটের রাস্তা। অবশ্য কিছু সময় কমও লাগতে পারে। গাড়ির স্পিড বেশির চাইতে আরেকটু বেশি করল উরফি। দেড় মিনিটেই পৌঁছাল ওরা। ওদের অ্যাপার্টমেন্টের মেইন গেট তখন বন্ধ। হর্ন দিতেই গার্ডরুম থেকে গার্ড এসে গেটটা ওপেন করে দিল। গাড়ি পার্কিংলটে রেখে লিফটে পাঁচতলায় উঠল ওরা। প্রত্যেকটা রুম অন্ধকার। ড্রয়িংরুমের দরজা হালকা করে ইনসেট করা। এভাবে কেউ দরজা ওপেন রাখে? একটা মোমবাতিও কেউ জ্বালায়নি কেন? ড্রয়িংরুমেও কেউ নেই। উরফি মোবাইলের ফ্ল্যাশে ওর রুমে চলে গেল। রুদ্র কোথায়? বাবা-মা’র রুমে নয় তো? এমন অ্যারিসটোক্র্যাটিক এরিয়াতে লোডশেডিং মানায়? কারও কোনো সাড়া-শব্দও নেই। গেল কোথায় সবাই? সুইটমেটের প্যাকেট শোকেসের ওপর রেখে শাওয়ার নিতে অন্ধকারে পা টিপে টিপে বাথরুমে ঢুকল হৃদিকা। অ্যাটাচ অ্যাক্রাইলিক বাটি বাথরুম। বেশ ফিটফাট। ফারনানের পছন্দের ডিজাইন বাথরুমটা। বাথরুম থেকে শাওয়ার নিয়ে বের হলো সে। ভেজা চুলগুলো টাওয়াল দিয়ে বেঁধে খোঁপা বানিয়ে মাথার ওপর ঢিবি করে রাখা, পরনে পাতলা উলের তৈরি ড্রেসিং গাউন, পারফিউম স্প্রে করা বডিতে, ভেলভেট কটনের ওড়না বুকের ওপর, ব্ল্যাক কালারের অ্যাঙ্কেল স্ট্র্যাপ স্যান্ডেল পায়ে। বেডরুমে আসতেই ইলেকট্রিসিটি এল। বড় করে শ্বাস নিল হৃদিকা। সিঁড়ি-ঘরের ওদিক থেকে পায়ের শব্দ পাচ্ছে সে। তাহলে কি সবাই ছাদে উঠেছিল? রুম থেকে দরজায় এল হৃদিকা। এসেই চমকে উঠল। অনেকটা ইলেকট্রিক শকের মতো। ফা-র-না-ন দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে। চোখটা কচলে নিল ও। শি ইজ কমপ্লিটলি অ্যাসটোনিস্ড টু সি হিম। হাউ ইজ ইট পসিবল? স্টুপিফাইড হলো বুকটা। ফারনানের কোলে রুদ্র ঘুমিয়ে। ফারনানকে দেখে কিছুই বলতে পারছিল না হৃদিকা। সে কি রিয়েলি ফিরে এসেছে? অ্যাহোয়াইল? নাকি রিপেন্ডলি?
-ফারনান বলল, এখানেই দাঁড় করিয়ে রাখবে? দরজা ছেড়ে দিল সে।
-হৃদিকা জিজ্ঞাসা করল, কখন এসেছ ফারনান? বাবা-মা কোথায়?
-বিকেলে এসেছি। ওনারা এতক্ষণ আমার সাথে ছাদে ছিলেন। এখন তাঁদের রুমে।
ভুল কি ভেঙেছে তাহলে ফারনানের? কত খুনসুটি, কত রঙ-বেরঙের অস্তিত্বের খোঁজে রাত্রি আলাপন, কত মুহূর্তকে হৃদয়ে ধারণ করে নিঝুম পরিবেশ সৃষ্টি! হৃদিকার আজ এমন লাগছে কেন? নীরবতা ভাঙছে না দুজনার। দুজন হারিয়ে যেতে থাকে দুজনার চোখের আইরিশে, বুকের অরণ্যে। 

                 
গল্পঃ জলরঙে লেখা বিমূর্ত  পাণ্ডুলিপি
 কলমেঃ  এম মনজুরুল ইসলাম
                                                                                                  শিবগঞ্জ, বগুড়া

                                                                                          

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ